ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

লবণ আমদানির শঙ্কা লক্ষাধিক চাষিরা

IFসেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও (কক্সবাজার) প্রতিনিধি::

বিদেশ থেকে আমদানির কারণে একটানা কয়েকবছর লোকসান গোনার মাঝেও চলতি বছর হঠাৎ করে লবণের রেকর্ড পরিমাণ দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আশায় বুক বাঁধে লবণ চাষিরা। এতে লবণ মৌসুম শুরুর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমে পড়েছেন কক্সবাজারের ৬ উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার অন্তত ১ লাখ চাষি। ধারণা করা হচ্ছে, দাম বৃদ্ধি থাকায় এবার প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে উৎপাদন হবে লবণ। এই অবস্থায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে উপরন্তু বিদেশে রপ্তানী করতে পারবে উৎপাদিত লবণ। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে আন্তরিক হতে হবে ।

এদিকে কক্সবাজারে ৬ উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় আগাম লবণ উৎপাদনে চাষিরা মাঠে নামলেও লবণ উৎপাদনের ল্যমাত্রা এখনো ঠিক করেনি বাংলাদেশ ুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)। অন্যান্য বছর যেখানে চলতি সময়ে আবহাওয়া অনুকূলে পাওয়া যেতনা সেখানে বর্তমানে লবণ উৎপাদনের জন্য পরিবেশ অনুকূলে রয়েছে। এতে চাষিরাও আগাম লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমে পড়েছেন।

সরজমিন দেখা গেছে, চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠ পুরোপুরি তৈরির তোড়জোড় চলছে। অনেক স্থানে শুরুই হয়ে গেছে লবণ উৎপাদন। সাধারণত আবহাওয়া লবণ চাষের অনুকূলে থাকলে এবং উৎপাদন মৌসুমে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে চাষিরা দিনরাত কায়িক শ্রম দিয়ে বিসিকের ল্যমাত্রার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করে থাকেন। এরই মধ্যে কুতুবদিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রান্তিক লবণচাষি সহায়-সম্বলহীন হওয়ায় মহাজনের টাকায় লবণ চাষের উদ্যোগ নিচ্ছেন বরাবরের মতো। তবে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লবণ আমদানির পাঁয়তারা নিয়ে তাদের মনে শঙ্কা কাজ করছে। প্রতিবছরই একশ্রেণির লবণ মিল মালিক সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করে থাকেন। এতে দরপতন ঘটে দেশে উৎপাদিত লবণের। এ কারণে একটানা কয়েকবছর মাঝপথে লবণ উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে চাষিরা।

বিসিক কক্সবাজারস্থ লবণ প্রকল্প অফিস জানায়, গেল মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়াসহ ৬ উপজেলার উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৬০ হাজার একর এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭ হাজার ২৫৬ একর জমিতে লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন চাষিরা। সরকারিভাবে লবণ উৎপাদনের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ লাখ মেট্টিক টন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ল্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। গত মৌসুমে উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৫৫ হাজার টন লবণ। ল্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কমায় স্থানীয় চাহিদা পূরণে সরকার দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয় মিল মালিকদের।

মহেশখালীর লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ছৈয়দুল কাদের বলেন, ‘গেল লবণ উৎপাদন মৌসুমের শেষ দিকে আবহাওয়া বৈরী থাকলেও সরকারের নির্ধারিত উৎপাদন ল্যমাত্রা পূরণ হয়। তারপরও কোরবানির ঈদের সময় পশুর চামড়া সংরণে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহের কথা বলে কিছু লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে সুযোগে কয়েক লাখ টন অতিরিক্ত লবণ আমদানি করা হয়। এতে একদিকে উৎপাদকরা যেমন তিগ্রস্ত হয়েছেন, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে পণ্যটি আমদানি করতে হয়েছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আফসার উদ্দিন বলেন, নভেম্বরের শুরু থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হলেও এখনো উৎপাদনের ল্যমাত্র ঠিক হয়নি, এর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আন্তঃ মন্ত্রণালয় ল্যমাত্রা ঠিক করে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতি বছর উৎপাদনের ল্যমাত্রা ঠিক করা হয়। এবারও আন্তঃ মন্ত্রণালয় লবণ উৎপাদনের ল্যমাত্রা ঠিক করবেন।

বিসিকের তথ্যমতে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলের প্রায় লাধিক চাষি লবণ চাষ করে থাকেন। এসব চাষি আরো অর্ধ লাধিক শ্রমিক লবণ চাষে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকেন। এতে প্রায় দেড় লাধিক মানুষ লবণ চাষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এছাড়া লবণ পরিবহন, মিলিং ও বাজারজাত করার কাজে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ প্রত্য ও পরোভাবে জড়িত হয়ে বছরের প্রায় ছয় মাস জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আর এসব কর্মম লোকের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক। এই লবণের ওপরই নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা। তাই লবণের বিষয়ে সরকারকে আন্তরিক হওয়ার দাবি জানান চাষিসহ লবণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

ইতিমধ্যে কুতুবদিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় লবণ উৎপাদন এবং বিক্রয় শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রান্তিক লবণ চাষি সহায় সম্বলহীন হওয়ায় মহাজনের টাকায় লবণ চাষে নেমেছেন বরাবরের মতো। তাই চলতি উৎপাদন মৌসুমে ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে লবণ আমদানির পায়তারা নিয়ে তাদের মনে শঙ্কা কাজ করছে।

কুতুবদিয়ার লবণ চাষি নেতা হুমায়ূন কবির বলেন, গত বছর পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন ও দাম ভালো পাওয়ায় চলতি মৌসুমে প্রতি একর জমির লাগিয়ত ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। একজন শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। সে হিসেবে একজন চাষিকে তিন কানি জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আবহাওয়া ভালো হলে ওই জমিতে উৎপাদন হতে পারে ৮ থেকে ৯০০ মণ লবণ। পুরো মৌসুমে মণ প্রতি গড়ে ৪০০ টাকা দাম না পেলে লাভের আশা অনিশ্চিত। বর্তমানে পুরাতন লবণ মণ প্রতি ৫০০ ও নতুন সাড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কুতুবদিয়ার লেমশীখালী ইউপি চেয়ারম্যান আখতার হোছাইন, সদর উপজেলার পোকখালী ইউপির গোমাতলী এলাকার আলাউদ্দিন জনি ও লবণ চাষি নেতা সাইফুদ্দিন বলেন, ল্যমাত্রার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন হলেও কিছু অসাধু মিল মালিক এবং সুবিধাভোগী আমলাদের কারণে গত বছরও আড়াই লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানি করা হয়। এবারো যদি এসব কুচক্রি মহলের ফাঁদে সরকার পা দেয় তবে কক্সবাজারের লাখো লবণ চাষি পথে বসবে।

বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রকৃতির বৈরি আচরণ না থাকলে বা আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হবে। বলা যায় বিসিকের ল্যমাত্রার চেয়ে এবার ১০ হাজার একর বেশি পরিমাণ জমিতে লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছে চাষিরা। এতে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদত ২০ লাখ মেট্টিক টন ছাড়িয়ে যাবে। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব হবে। সরকারকে আন্তরিক হওয়ার আহবান জানাচ্ছি, যাতে সংকট দেখিয়ে মধ্যসত্ত্বভোগীরা বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পায়তারা করলেও সুযোগ না দিতে।

[/highlight]

পাঠকের মতামত: